আজ হাফিজার পরিক্ষার রেজাল্ট বের হবে। তাই সকাল থেকে ও ভিষন অস্থির হয়ে আছে,কেমন এলোমেলো লাগছে সবকিছু। মাথার চিন্তা গুলো গুলিয়ে যাচ্ছে হাত পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।বার বার পানি খেয়েও কাজ হছছেনা একটু পরেই আবার গলা সুকিয়ে যাচ্ছে ।ওর পরিস্কার মনে আছে পরিক্ষার হলে সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক মতই দিয়েছিলো কোন সমস্যা হয়নি।তবে ভয় পাচ্ছি কেন? নিজেকে বলল ও।‘হাফিজা!ঘর থেকে বের হবি তুই? ওর বান্ধুবি কাকলির গলা ওর কানে এলো, সব চিন্তা বাদ দিয়ে তারা তারি ওরনাটা মাথায় দিল । একটুপর ব্যাগ হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ও,বাড়ির উঠানে ছোট বোনটা খেলছিল।ঘরের সাথে লাগানো পেয়ারা গাছটাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে কাকলি,ওর মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।‘এতো যলদি বের হলি ক্যান! আর একটু দেরিতে আসতি! একবারে ssc পরিক্ষার রেজাল্ট সহ আনতে যেতে পারতি।ওর গলায় চরম বিরক্তি ঝরে পরল।সেই কখন থেকে হাফিজার অপেক্ষা করছে।অথচ এতোক্ষনে ঘর থেকে বের হলো ও।প্রতিটা দিন ইস্কুলে যাবার সময় ওর অপেক্ষা করতে করতে মেজাজটা বিগড়ে যায় কাকলির।হাফিজা কিছু বললনা শুধু ওরদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।হেটে সামনে খেলতে থাকা ছোট বোনটার পিঠে হাত রাখলো,আলতো গলায় বললো
মা’কে একদম জালাবি না ঠিক আছে?
মাথা ঘুরিয়ে বোনের চোখে চোখ রাখলো মেয়েটা।খুব সুন্দর চেহারা তার তবে,এই মুহূর্তে ওর দুই চোখে কাজল লেপটে আছে, ঠোটের লিবিছটিক ঠোট ছারিয়ে থুতনি ওবধি নামানো, সারামুখে পাউডারএ মাখামাখি সবমিলিয়ে অদভূত হাস্যকর দেখাছছে ওকে
‘তাহলে নতুন আর একটা লিবিছটিক কিনে দিবা আমাকে?কচি গলায় আবদার করল বাচ্চাটা।
সে সাজুগুজু করতে খুবই পছন্দ করে,তবে তার একটা জীদ আছে, কারো হাতে নয় নিজে নিজে সাজবে।কেউ তাকে সাজিয়ে দিতে চাইলে কেদেঁকেটে অস্থির হয়ে যায়। তাই কেউ তাকে সাজিয়ে দেবার ভুল করেনা,একবার যদি কান্নার সুর ওঠে তবে তা থামানো মুস্কিল।
‘তাহলে আমার সাথে রাতে পড়তে বোসবিতো ?
‘ঠিক আছে। বাধ্য মেয়ের মতো মাথা কাত করলো ছোট্ট মেয়েটা।হাফিজা নিচু হয়ে বোনের গালে চুমু দিল,তারপর কাকুলির দিকে তাকিয়ে বলল ‘চল!
ওরাদুজন ইকটু সামনে আগাতেই হাফিজার মাকে দেখল,তিনি ওদের দিকেই এগিয়ে আসছেন ওনার হাতে একটা টিনের জংধরা বালতি তাতে ছাই ঠাসা।তার হাল্কা সবুজ রঙের শাড়ীতে ছাই মাখামাখি হয়ে আছে।চুলো থেকে ছাই তুলে বাগানে[ জংগল] ফেলছেন উনি।রান্নার আগে চুলো থেকে ছাই না ফেললে চুলোতে আগুন ধরাতে সমস্য হয়।ওদের সামনে এসে হাতের বালতি নামিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘামার্ত মুখটা মুছলেন ।মহিলা ভীষন সুন্দরী ছিলেন একসময়।কিন্তু এখন তার চেহারার সেই সুন্দরয্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।মাথা ভর্তি চুল টানা টানা চোখ কাচিহলুদের মত গায়ের রং সবই ছিলো তার,তবে হাফিজার বাবা মারা যাবার পর তার সরিল স্বাস্থ্য একদমই ভেঙ্গে যায়।আজ ৭ বৎসর হয় স্বামীহারা হয়েছেন। সবকিছু বদলে গেলেও নিজের ভেতরের শোক আজো কাটিয়ে উঠতে পারেননি,সেই ছাপ তার চেহারাজুড়ে বিরাযমান,বয়স মাত্র ২৯,অথচ মনে হয় যেন ৪৫ পার করেছেন।
‘মুখটা ওমনটা শুকনো লাগছে ক্যান মা!প্লেটের ভাত কয়টা খাসনি?হাফিজাকে বললেন তিনি
‘না মা..ভালোলাগ ছিলনা, ও সত্যি কথাটাই স্বীকার করল।
‘কেন?পরে স্কুলে মাথা ঘুরবেতো..। ওনার কণ্ঠে একরাশ উদবেগ ঝরে পড়লো।
‘কিছছু হবে না মা!এখন যাই দেরি হছছে..। বলেই কাকুলির হাত ধরে টান দিল ও।পেছনে মা বলে উঠলো
‘ইকটু দাড়া! আমি না হয়ে কটা খাইয়ে দি; কিন্তু ততক্ষনে ওরা দুজন বাড়ীর সরু রাস্তা ছেড়ে, বড় রাস্তায়ে উঠে গেছে। মায়ের কথা সোনার অপেক্ষা আর করলোনা,দ্রুত সামনে আগালো। ‘সব সময় রেজাল্টের দিন তুই খালি খালি টেনশন করিস; কিছুদুর যাওয়ার পরে বললো কাকুলি।
‘তুই এম্নিতে ও ফাস্ট হবি ওম্নিতেও ফাস্ট হবি, ইশ’.. তোর কপাল টা যদি আমার হত;। বিরবির করতে লাগলো ও।কিন্ত হাফিজার এসব কোন কথাই কানে ঢুকছেনা।ওর মনোযোগ ওন্যখানে,রাস্তার পাশে বাগানের ভেতর দিয়ে ওর বাবার কবর টা দেখা যায়।ও অপেক্ষা করছে কখন গাছপালার আড়ালে বাদাম গাছটা চোখে পড়বে।আজ রেজাল্ট দেবে বাবার কাছে দো’আ না চেয়ে ও কেমনে যায় ইস্কুলে?অবশেষে ঝোপঝারের মধ্যে বাদাম গাছটা দেখতে পেয়েই থমকে দাড়লো সে,বাদাম গাছের গোড়ায় বেতঝোপ,তার পাসেই ওর বাবার কবরস্থান।প্রথমে মনেমনে কবরস্থানের দো’আ টা পড়ে নিল তারপর চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল্ল,
‘বাবা আজ আমার রেজাল্ট দিবে তুমি আমার জন্য দোআ করবে যেন রেজাল্ট ভাল হয় আর আমি থানা হাই স্কুলে চান্স পাই……;হাফিজা আরো অনেক কছু বলল,কিন্তু সেটা ওর বুকের ভিতরে চাপা ই থাকলো। যখন ও চোখ খুলল তখন ওর চোখের কোনে পানি জমেছে,এমনটা সবসময়ই হয় বাবার কবরের কাছে আসলেই খালি খালি ওর চোখে পানি আসে, যখন বাবার কথা ভাবে তখন ও ওর কান্না পায়। কেন এমন হয় ও বুজতে পারেনা,মা বলেছে ও যে, ওর বাবাকে খুব বেসি ভালোবাসে তাই এমন হয়।ভালবাসার মানুষেরা যখন মারা যায় তখন তাদের কথা মনে পড়লেই চোখে অশ্রু আসে।এটা সাভাবিক ব্যাপার।
‘চল!চল!তারাতারি চল,১২টা বাজতে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি; কাকুলি তারা দিল। ওরা আবার হাটা শুরু করল। কিন্তু অল্প কিছুদুর গিয়ে আবারো ওদের হাটার গতি থেমে এলো,সামনেই ওদের সহপাটি মনির ঘর।ওরা দেখতে পেলো মনি ওর বাবার মোটরসাইকেলে বসা, ওর বাবা সাইকেলে স্টার্ট দিচ্ছেন।মনি ওদের দেখে হাত নাড়লো,জবাবে কাকুলি আর হাফিজা ও হাত নাড়লো।
‘তুমি রেডী? মনির বাবা মনিকে বল্লেন।মনি পেছন থেকে তার বাবা কে জড়িয়ে ধরলো।
‘বাবা মনে আছে তো! ফাস্ট হলে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছিলে? মনি বলল।মনির বাবা মাথা ঝাকি দিলেন। ‘হ্যা মা অবস্যই মনে আছে ঢাকা নিয়ে তোমাকে চিরিয়াখানা দেখাবো,জাদুঘর ও দেখাবো…’বলতে বলতে উনি মটরসাইকেল সামনে বাড়ালেন।হাফিজা তাকিয়ে থাকলো, মনির বাবার মটরসাইকেল রাস্তার ধুলোউড়িয়ে্ আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেল।
‘দুজন মানুষ কে আমি ভীষন হিংসে করি বুঝলি! কাকুলি বলে উঠলো হটাৎ
‘কি বললি? হাফিজা ওর কথাটা ঠিক মত সুনতে পায়নি।কাকুলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছারল;বলল
‘বললাম দুজন মানুষ কে আমি ভীষন হিংসে করি….হাফিজা ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ও কি বলতে চাচ্ছে বুঝতে পারছেনা।
‘এক হলি তুই, শুধু মাত্র নোট পড়ে পরিক্ষাদিস। আর রেজাল্ট করিস সবার চেয়ে ভালো,সারাদিন কত স্যারের কাছে পড়ি।ঘরে বাবা পড়ায়,মা পড়ায় তারপরও মার্কে তোর ধারে কাছেও যেতে পারিনা।ক্যেমনে যে পারিস!তুই যানিস আর আল্লাহ যানেন,আর এক হলো ওই মনি! অমন লক্ষি একটা বাবা ওর.. মেয়ে যা বলে!তাই শোনে আহ!ওমন পিতা কয়জনের কপালে যোটে।
হাফিজাকে কথাটা খুব নাড়া দিলো।সত্যি তো কয়জনের কপালে জোটে পিতা?সারা রাস্তা কাকুলি কত কথাই না বলল।হাফিজা চুপচাপ শুধু শুনলো আর হু হা করলো।মনের ভিতরে ওর ওন্য ভাবনা ঘুরছিলো।ও ভাবছিল বাবার কথা।যদি আজ বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে ও মনির মতো কত কিছুর আব্দার করত!বাবা নিশ্চয় ওর সব কথা শুনতো।কাকুলি বলত ‘হাফিজা তোর বাবাটা কত্ত লক্ষী!তখন ওর কি গর্ব হতো,হাফিজা ভাবছিলো আর বরবার ঢোক গিলছিলো বুকের ভেতর
কেমন কষ্ট হছছিল।চোখের সামনে রাস্তাটা বারবার ঝাপসা দেখাচ্ছিল।
২ঘণ্টা পর……হাফিজার হাতে পরীক্ষার ফলাফলের কাগজ। ও ভীষন খুসি!এতোটা খুসি সে জীবনে এর আগে কখনো হয়নি,সকালের সেই টেনশন,হাত পা ঝিমঝিম ভাব পুরোপুরি উধাও!ওর বান্ধুবীরা সবাই ওকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে,ও সবার সাথে কথা বলছে আর হাসছে,ওর পাশে কাকুলি দাঁড়ানো হাফিজার কাধে ওর হাত। তার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওর রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি,কিন্তু নিজের রেজাল্ট নিয়ে এখন ওর ভাবার সময়ে মোটেও নেই,হাফিজার রেজাল্ট নিয়ে ওআছে,পরিচিত যেসব গার্জিয়ান দের দেখছে,সবাই কে বলছে ‘আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হাফিজা, ও চান্স পেয়েছে থানা স্কুলে;জী,…জী..., আমার ফ্রেন্ড! ইস্কুল জুড়ে আজ ভিষন সোরগোল।প্রতি বৎসরই বার্সিক রেজাল্টের দিন এমনটা হয়।ক্লাস ফাইভের ছাত্র ছাত্রীরা আজ বিদায় নিবে।তাই যারা বিদায় নিছছে,তাদের অনেকের সাথে গার্জিয়ানরাও আছেন।তাদের কথার আওয়াজের সাথে ছাত্র ছাত্রিদের হাসির সব্দ।ওরা সবাই নিজেদের রেজাল্ট নিয়ে আলোচোনা করছে ।সব মিলিয়ে গমগম করছে পুরো ইস্কুল। হাফিজা বার বার নিজের রেজাল্টের পেপার টা দেখছে আর অভিভূত হয়ে পড়ছে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা যে ও থানা ইস্কুলে চান্স পেয়েছে!শুধু তাই না গড় নাম্বারে ও ওদের ক্লাসে সবার থেকে এগিয়ে। সবচে বড় ব্যাপার হলো থানা ইস্কুলে চান্স পাওয়াটা,কারন ওখানে ওদের পুরো জেলার মেধাবী ছাত্র ছাত্রিরা পড়ে।ওখান থেকে পাশ করে বের হলে ঢাকার ভাল কলেজে ভর্তি হওয়া যায়।ওদের গ্রাম থেকে প্রথম বারের মত এবার দুজন ছাত্রি ওখানে সুযোগ পেয়েছে।এক ও আর একজন হল মনি,মনির কথা মনে পড়তেই ভিড়ের মধ্যে ওকে দেখার চেষ্টা করল হাফিজা কিন্ত ওকে চোখে পরলনা,অবশেষে ভিড় ঠেলে সামনে আগালো ও মনিকে অভিনন্দন জানানো দরকার।‘এই,কোথায় যাস তুই? পেছনে সুনতে পেলো ও।‘এখানেই থাক আমি আসছি। একসাথে বাড়ি ফিরবো ঠিক আছে?কাকুলিকে উত্তর দিলো।মনিকে বেসি দূর খুজতে হলনা,হল রুমের শেষপ্রান্তে।ওর বাবার সাথে দাঁড়ানো ছিল।ওর বাবা কথা বলছিলেন আর হাসছিলেন তাকে খুব সুখি দেখাছছিল।ওদের দুজন কে ঘিরে কয়েক জন স্যার আর কিছু গার্জিয়ান দাঁড়ানো।হাফিজা সুনতে পেল মনির বাবা বলছেন ‘আমার বিশ্বাসই হছছেনা আমার মেয়ে থানা ইস্কুলে চান্স পেছে!এটা..এটা আমার কাছে আনেক বড় পাওয়া।আমি..আমি সত্যি খুব গর্ববোধ করছি।আমার নিজের উপর যে আমি তার বাবা,আর তার উপর যে সে আমার মেয়ে!আপনারা আমার মেয়েটার জন্য দোআ করবেন।সে যেন জীবনে আনেক বড় হয়। হাফিজা আর সামনে আগাতে পারলোনা ওখানেই দাড়িয়ে রইলো।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনি আর তার বাবার দিকে।মনি হাত দিয়ে ওর বাবার হাতটা ধরলো।ওর চেহারা খুসিতে ঝলমল করছে।হাফিজা বুকের ভেতর চিনচিন করে একটা ব্যাথা ওনুভব করলো।ওর হাসিখুসি মুখটা হটাৎ মেঘের আন্ধকার নেমে এলো।ও ওখানে আর এক মুহূর্তও দাড়ালোনা।পেছন ফিরে দৌড় দিলো।ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি নামছে,ওর অজান্তেই চোখে পানি এসেছে ‘আমি এমন বোকার মত দৌড়াছছি কেন?কিছুদুর গিয়ে ভবলো ও। ইস্কুলের শেষ প্রান্তে চলে এলো হাফিজা। এখান থেকে ওর বাবার কবরের সেই বাদাম গাছটা দেখা যায়।সে এখানে সবসময় আসে টিফিনেরছুটির সময় একবার এসে বাদামগাছটার দিকে তাকিয়ে কথা বলে।ও সিঁড়িরশেষ ধাপটার উপর বসে পড়লো মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেই ছোট্ট বেলায় বাবা মারা গেছে।বাবা দেখতে কেমন ছিলো তাও স্মরণ নেই ঠিকমতো।কিন্ত যখন থেকে ও বুজতে সিখেছে যে মানুষ মারা গেলে আর কনোদিন ফিরে আসেনা,তখন থেকেই বাবার অস্তিত্ব অনুভব করলো ওর নিজের ভেতর।সব সময়ে বাবার কল্পনা ঘিরে রাখে ওকে।তবে আজকের মতো এমন কষ্ট আগে কখনো হয়নি।আজকে ওকে বারবার যেভাবনা নাড়া দিচ্ছে তা আগে কখনো নাড়া দেয়নি।ওর চোখের সামনে শুধু মনির বাবার মুখটা ভেষে উঠছে,সে কেমনে তার মেয়ের প্রশংসা করছিল। সবার কাছে দোআ চাইছিলো…তাকে কি ভিষন গর্বিত লাগছিল….আহ,..বাবা তুমি জদি বেচে থাকতে..কান্নামিশ্রিত গলায় বলল হাফিজা,তা হলে আমায় নিয়েও তোমার এমন গর্ব হত!আমার কথা তুমিও সবার কাছে বলতে!বলতে দেখুন আমার মেয়েটা কত ভালো রেজাল্ট করেছে আমার গর্ব হচ্ছে…যে আমি তার বাবা। হাফিজা ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো,মাথাটা হাটুর সাথে চেপে রেখেছে।ওর পিঠ আর কাধ কান্নার তোরে কেঁপে কেঁপে উঠছে।‘আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা ও করবেনা,আমাকে নিয়ে কেউ গর্ব ও করবেনা।আমাকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই।আমাকে নিয়ে গর্ব করার কেউ নেই…. হাফিজা নামের অবুঝ মেয়েটি আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো। কষ্টে ওর বুকটা ভেঙ্গে যাছছে।কিছুতেই ও আজ নিজেকে সামলাতে পারছেনা।আর সামলাবেই বা কেন?আজ ও কাঁদবে ইচ্ছে মত কাঁদবে,শুধু বাবার জন্য কাঁদবে, কেন বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেল?বাবার কি একটুও চিন্তা নেই ওর জন্য?ওর বোনের জন্য!মার জন্য?আজ ওদের কেউ নেই।বাবা নেই তাই কেউ নেই।আজ ওর এতো গর্বের দিন,কিন্তু ও কাঁদছে..কেন?হাফিজা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো দেখল কত বাবারা রয়েছেন আজ ইস্কুলে।কিন্তু কই কেউ তো ওর দিকে ফিরে ও তাকাচ্ছেনা।অথচ ও তো মনির মতোই ভাল রেজাল্ট করেছে!তাহলে মনি হাসছে আর ও কাঁদছে কেন?...কেন?আর যদি বাবা থাকতো...বাবার হাত ধরে সারা ইস্কুল ঘুরে বেড়াত…কত কিছু করতো…কান্নার ত প্রশ্নই আসতনা, হাফিজার চোখের পানি টপ টপ করে সিঁড়িতে পরতে লাগল। সময় গড়িয়ে চলল। ওখানে বসে বসে ও কাঁদতে থাকলো। ‘হাফিজা! হটাৎ হাফিজার কানে একটা ভারি গলার সব্দ এলো। এবং সাথে সাথে ও চিনতে পরলো যে গলাটা ওদের ইস্কুলের হেড স্যারের গলা।ও জায়গায় জমে গেল।কান্না বন্ধ হয়ে গেছে মুহূর্তেই।তারা তারি ওড়না দিয়ে অশ্রুশিক্ত মুখটা মুছতে মুছতে উঠে দাড়ালো।যখন ঘুরে স্যারের মুখোমুখি হলো,তখন ওর দৃষ্টি নিচে।
‘জী স্যার;। যদিও চেষ্টাকরেও গলা থেকে ইকটু আগের কান্নার প্রভাবটা দুরকরতে পারলনা।
‘কিরে তুই কি ফেল করেছিস? স্যার গমগমে কণ্ঠে বললেন।
‘না স্যার;। হাফিজা কিছুটা ভড়কে স্যার এর দিকে তাকালো।
‘তাহলে ফেল করা ছাত্রিদের মত কাঁদছিস কেন? হাফিজা তারাতারি মাথা নিচু করল,কি উত্তর দেবে ভেবে পাছছেনা। স্যার ভিষন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।বুঝতে পারছেননা।এত খুসির দিনে মেয়েটা কেঁদে কেদেঁ বুক ভাসাচ্ছে কেন,মুখটা লাল হয়ে আছে,চেহারাতে চরম অসুখি ভাব।এমন মন খারাপ তো আগে কখনও দেখেন নি।সাধারনতো সে ইকটু চুপচাপ সভাবের হলেও সবসময়ে তার মুখে অদ্ভুত সুন্দর মূদু হাসি লেগে থাকে,বয়সের তুলনায় তার ভিতরে আনেক বেশি বুদ্ধি ক্ষমতা আর সচেতনতা রয়েছে। কিন্তু আজ ওকে কাদঁতে দেখে,স্যার থমকে গেলেন।ভেবে পাচ্ছেননা কি বলবেন। তিনি পকেট থেকে দুটো একশ টাকার নোট বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘নে এটা আমার তরোফ থেকে উপহার; নরম কণ্ঠে বললেন।
হাফিজা বোকার মত স্যারের বারানো টাকার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘নে ধর! তিনি হাত ঝাকি দিলেন। হাফিজা তারপর ও অনড়। স্যার ওর হাত ধরে মুঠোতে টাকাটা গুযে দিলেন। তারপর পরম মমতায় ওর মাথায় হাত রাখলেন। কত অল্প বয়সে বাবা হারিয়েছে মেয়েটি।আদর যত্ন নেই,গাইড নেই।অথচ যেদিন থেকে এই স্কুলে পা রেখেছে সেইদিন হতে ওর প্রতিভার আলো,ছড়িয়েছে।শেষ ওবধি থানা ইস্কুলে চান্স পেয়ে সে প্রমান করল,অদুর ভবিস্যত তার উজ্জলসম্ভাবনাময়,এবং যে গর্ব সে বয়ে এনেছে ,তা তার নিজের আর এই স্কুলের জন্য এক পড়মপাওয়া।আসেপাশের আর দশটা স্কুলের জন্য যা কেবলই স্বপ্ন!
‘তোর ছোট বোন কে নিয়ে বাজারে যাবি তারপর রসুর মিষ্টির দোকান থেকে ইচ্ছে মত রসগোল্লা খাবি…কেমন? তোর মায়ের জন্য দুটো আনতে মনে থাকে যেন!।বললেন স্যার
‘আর এখানে একাএকা বসে কাঁদছিলি কেন বলতো আমায়?আজ কি তোর কাঁদার দিন বোকা!আজতো গর্বের দিন,এই দেখ আমার কি ভিষন আনন্দ হচ্ছে!কি গর্ব হছছে!ভাবছি যদি তুই আমার মেয়ে হতি!তাহলে আমি কত বড় ভাগ্যবান হতাম! হাফিজা মাথাতুলে স্যার এর দিকে তাকালো, ‘স্যার এটা কি বললেন!ও যদি স্যারের মেয়ে হতো! স্যার হাফিজার তাকানো দেখে এতক্ষণে বুঝলেন মেয়েটা কাঁদছিলো কেন…সহসা ওনার বুকের ভেতর কষ্টের একটা ঠেউ আছরে পড়লো।উনি বুকের ভেতর একটা ব্যথা ওনুভব করলেন।ছোট্ট মেয়েটা! আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে আর বাবার অপূর্নতার হাহাকার ও বাড়ছে।তার এই অপুর্নতা পুরন করা কি কখনো সম্ভব?স্যার তার বাড়িতে রেখে আসা ছোট মেয়েটার কথা ভাবলেন, আহ… তিনি আজ বেঁচে আছেন তাই কখনো এমনটা চিন্তাও করেননি, তার মেয়ে যা পেয়েছে,তা এই মেয়েটি পায়নি।তাই তো তার আনন্দর মাঝেও দুঃক্ষের ছায়া ঘিরে আছে।তিনি কি পারবেন মেয়েটার অবুঝ হৃদয়ে একটু সান্ত্বনার পরসবুলাতে?কারন তিনিও তো একজন বাবা।পৃথিবীর সব পিতা তো এক মাটিতেই তৈরী!তাহলে কেন পারবেন না?
‘তুই তো আমার মেয়েই পাগলি! আমিতো তোর বাবার মতই; তিনি মমতামাখা স্বরে বললেন।
‘আপনি আমার জন্য দোআ করবেন স্যার;। হাফিজা বুদ্ধিমান মেয়ে,সঠিক সময়ই কথাটা বলল।
‘দোআ তো করব অবস্যই তবো আমাকে তোর কথা দিতে হবে,এত দিন যেভাবে পড়েছিস এখন থেকে তার চেয়ে আরো ভাল করে,আরো বেশি বেশি পড়তে হবে।
‘জী স্যার; হাফিজা কথাদিলো
‘এই স্কুলে যেমন ভাল রেজাল্ট করেছিস,ওখানে এর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে এস এস সি পাশ করতে হবে,কি?পারবিনা?শুধু বাবাকে চিন্তা করে করে কাঁদলে ত হবেনা মা!কিভাবে তোমার বাবার গর্ব,তোমার বাবার সন্মান বাড়াতে পারো সেই চিন্তা করতে হবে,যাতে মানুষেরা বলতে পারে ,যে দেখ!আবু সাইদ [হাফিজার বাবার নাম]এর কত ভাগ্য, তার কত গর্ব।তার মেয়েটা তার সম্মান রেখেছে।তার নাম রেখেছে,ভালো মানুষের সন্তান ভাল হয়েছে।ভালো মানুষ হয়েছে;
‘জী স্যার; হাফিজা টান টান হয়ে উত্তর দিল। নিজের কণ্ঠ সুনে ও নিজেই আবাক হয়ে গেল। ইকটু আগের সেই অভিমানী আবেগি মেয়েটির ছাপ তার চেহারা থেকে হাড়িয়ে গেছে।বরং ওর চেহারায় এখন আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয়ে ঝলমল করছে।ফিরে এসেছে সেই চিরচেনা মৃদু হাসি।মনে হয় কোন যাদুর ছোঁয়াতে ও মুহূর্তে বদলে গেল।স্যার ওর মুখের রং ফিরেছে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন,না হয় সারাদিন খুসির মাঝেও কষ্টের সাগরে ডুবে থাকতে হত তাকে।অল্প কথায় যা বোঝাতে চেয়েছেন তা বোঝাতে পেরেছেন,ওর ভেতরে নাড়া দিয়ে বাস্তবে ফিরিয়ে এনেছেন।
‘আমার সাথে ওদিকে চল! মনিকেও বকশিশ দিতে হবে; বলেই তিনি হলের দিকে হাটা শুরু করলেন।হাফিজা ওখানেই দাড়িয়ে রইলো।ওর বুকের ভেতরের ঝড় থেমে গেছে..নিজেকে হাল্কা মনে হচ্ছে। স্যারের চলে যওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে ও।তিনি যে কথা গুলো বলেছেন তা যেন এখনও কানে ভাসছে।কেন যেন মনে হচ্ছে। তার চেহারা বাবার মত আথবা বাবা দেখতে স্যারের মত ছিলেন।আগে কখনো এমনটা মনে হয়নি তবে এখন তাই মনে হচ্ছে।‘আপনি ঠিকি বলেছেন!...আপনি আমার বাবার মতই...; বিরবির করল হাফিজা।তিনি কি সামান্য কিছু কথা ওকে বললেন,অথচ এই কথাটুকু ওর মনটাকে এতো শান্ত আর শান্তির আবেসেজড়ালো!মনে হলো,কথাগুলো স্যার না বাবা বললেন…. ওর চোখে আবারো ভিজে উঠতে চাইলো।ও বাগানের গাছপালার দিকে তাকালো,বাদাম গাছটার বড়বড় সবুজবাদামি পাতা বাতাসে দোল খাচ্ছে। ওখানেই ওই নিড়িবিলি সবুজ ঝোপ ঝারের নিচে ঘুমিয়ে আছে বাবা।আর কোন দিন তার এই ঘুম ভাংবেনা।আর কখনো ফিরে আসবেনা,কিছু বলবেনও না হাফিজাকে। ‘তাতে কি হয়েছে;?হাফিজা ভাবলো। মা বলেছে,ভেহেস্তে বাবার সাথে দেখা হবে,আর সেদিন তিনি সব কিছু জিজ্ঞাসা করবেন।কেমন রেজাল্ট করেছি,কি খেতে ইছছে করে, কিদেখতে ইছছে করে।সব কিছু…….,সেদিন বাবা এক মুহূর্তের জন্য ওদের রেখে কোথাও জাবেননা।আনন্তকাল তিনি কাছে থাকবেন।ওদের ভালোবাসবেন,তখন আর মনে হবেনা বাবা কোথায় গেলেন ওদের ছেড়ে?হাফিজার বুকচিরে দির্ঘ্য নিঃশাস পরলো।কিন্তু এখন এসব ভাববেনা ও, স্যারকে দেয়া কথা রাখতে হবে।বাবার কথা ভেবে ভেবে কাদলে হবেনা,তার সপ্ন সত্যি করতে হবে,মায়ের সপ্ন সত্যি করতে হবে,ওকে আরো ভাল পড়াশুনা করতে হবে।মানুষের মতো মনুষ হতে হবে। বাবা ওর পাসে আছে, থাকবে। হাফিজা সামনে আগালো।ওকে সারাদিন এখানে দাড়িয়ে থাকলে হবেনা,কাকুলি ওর অপেক্ষা করছে,অপেক্ষা করছে মা।তাকে ফলাফলের খবরটা যানাতে হবে।তার পর বোনকে নিয়ে বাজারে জাবে মিষ্টি খেতে।ওকে একটা নতুন লিবিছটিক ও কিনে দিতে হবে,ও হ্যা….বাড়ি ফেরার পথে বাবার কবরস্থানে ও তো থামতে হবে,তাকে বলতে হবেনা খুসির খবরটা?আজ হাফিজার এত গর্বের দিন…….!